লাইসেন্স বিহীন হাসপাতাল বন্ধ করে দিলেই কি স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন হবে?
লাইসেন্স বিহীন হাসপাতাল বন্ধ করে দিলেই কি স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন হবে?
যে কোন দেশের স্বাস্থ্য সেবা কিসের উপর নির্ভরশীল? এটি কি শুধু চিকিৎসক বা হাসপাতালের উপর নির্ভর করে? শুধু ডাক্তার বা হাসপাতাল ভালো হলেই কি স্বাস্থ্য সেবা ভালো হবে? যে কোন প্রতিষ্ঠানের মত স্বাস্থ্য সেবার মান কেমন হবে তা নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপর- স্বাস্থ্য সেবা সিস্টেম, চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট এর মান, স্বাস্থ্য সেবার খরচ কে দেবেন- রোগীরা নাকি ইন্সুরেন্স কোম্পানি, ভোক্তা (যারা স্বাস্থ্য সেবা নিবেন) ইত্যাদির উপর।
স্বাস্থ্য সেবাগুলোকে সাধারণত কয়েকভাগে ভাগ করা হয়- ১) প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ২) বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য সেবা ৩) জরুরী স্বাস্থ্য সেবা।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা বলতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যে স্বাস্থ্য গত সমস্যা দেখা যায় সেগুলো যেমনঃ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথা ব্যথা, প্রেসার ও ডায়াবেটিস চেক আপ, গর্ভবতী মায়ের চেক আপ ইত্যাদি। এই প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাগুলো আমাদের মোট স্বাস্থ্য সেবার ৮০-৮৫ ভাগ। মানুষের এই প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাগুলো যদি নিশ্চিত করা যায় তবে স্বাস্থ্য খাতের ৮০-৮৫ ভাগ লোড কমানো যাবে। দুঃখের বিষয় হলো এই প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য যে প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসক দরকার (জিপি সেন্টার) সেগুলো আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই। সেজন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার জন্যও মানুষ হাসপাতালগুলোতে আসে। তাই হাসপাতালগুলো স্বাভাবিকভাবে যে সার্ভিসগুলো দেয়ার কথা সেগুলো বিঘ্নিত হয়। তাই সবার আগে স্বাস্থ্য সেবা সিস্টেম নিয়ে আমাদের কাজ করা উচিত।
চিকিৎসক একটি স্বাস্থ্য সেবার কেন্দ্র বিন্দু। একটি দেশে কতজন চিকিৎসক দরকার, কতগুলো মেডিকেল কলেজ দরকার, কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি মেডিকেল শিক্ষার্থী হতে পারবেন সেগুলোর রূপরেখা প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে মেডিকেল শিক্ষা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন। এই পেশার সকলকে সব সময় পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হয়। উন্নত দেশের সিস্টেমে তাদের দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরাই কেবল মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পান। শুধু তাই নয়, মেডিকেল শিক্ষা শেষ করে প্র্যাকটিস করতে পারবেন কিনা তার জন্য লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে হয়। লাইসেন্স পেলে তা নবায়নের জন্য রেগুলার CME, symposium, seminar এ অংশগ্রহণ করতে হয়। আমাদের দেশে এতটা সূক্ষ্ম বাচাই হয় না এবং লাইসেন্সিং পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই এবং নবায়নের জন্য শুধু ফি দিলেই হয়। বর্তমান সিস্টেমের মধ্যে মানসম্মত চিকিৎসক সব সময় আশা করা যায় না।
আমাদের দেশের প্রচুর বেসরকারি ক্লিনিক, নার্সিং হোম ও হাসপাতাল আছে। দেশের কোথাও কোন রোগী মারা গেলেই প্রশ্ন আসে ওই হাসপাতালের লাইসেন্স আছে কিনা? এবং একটা মহড়া শুরু হয় লাইসেন্স বিহীন হাসপাতাল বন্ধ করার জন্য। কয়েকদিন পর সব ভুলে যাই আমরা। আমাদের দেশের বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স করার প্রক্রিয়াটা অন্যরকম। আপনি একটি হাসপাতাল গড়ে তুলবেন এরপর লাইসেন্সের জন্য আবেদন করবেন। এরপর আপনার হাসপাতাল পরিদর্শনের জন্য আসবেন, উনারা দেখে বেশ কিছু জিনিসের ব্যপারে অবজারভেশন দিয়ে যাবেন, যেগুলো ঠিক না করলে লাইসেন্স দেয়া যাবে না। দুর্ভাগ্য হলো যে পয়েন্টগুলো একটি হাসপাতালের জন্য অত্যাবশ্যক যেমনঃ আলাদা ব্লিডিং, রোগীদের চলাচল, বসার জন্য আলাদা জায়গা, বাতাস চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত স্পেস, বজ্য অপসারণ ব্যবস্থা ইত্যাদি। এগুলো বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালে সম্ভব হয় না। তাই লাইসেন্স দেয়া হয় না। অন্যদিকে যারা হাসপাতালে বিনিয়োগ করেছেন তারা ইতিমধ্যে অনেক টাকা খরচ করে ফেলায় হাসপাতাল কার্যক্রম বন্ধ করেন না, আবার পরিদর্শনের সব পয়েন্টের ব্যবস্থাও নিতে পারেন না।
আবার স্বাস্থ্য প্রশাসনের জনবল সংকট চরমে থাকায় যে হাসপাতালগুলো লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেন সেগুলো টাইমলী পরিদর্শন করা হয় না। তাই যে কোন সময় প্রাইভেট হাসপাতালে পরিদর্শন হলে দেখা যাবে বেশিরভাগ হাসপাতালের লাইসেন্স আপটুডেট নেই।
এমতাবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স প্রক্রিয়ার পরিবর্তন খুব জরুরী এবং হাসপাতালের নিয়মিত মনিটরিং, নবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ এবং স্বাস্থ্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ম্যাজিসট্রেসি ক্ষমতা প্রদান অত্যন্ত জরুরী।
চলবে……
……………………………………………………………………
ডাঃ রতীন্দ্র নাথ মন্ডল
সহযোগী অধ্যাপক
মেডিসিন বিভাগ
প্রাইম মেডিকেল কলেজ
প্রতিষ্ঠাতা- ডাক্তারখানা (জিপি সেন্টার)